দায়েমী ফরজ ও দায়েমী সুন্নত: ২৪ ঘণ্টার আমল

একজন মুমিনের জীবন শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস এবং প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর হুকুম ও রাসুল (সা.)-এর তরিকায় অতিবাহিত হওয়া উচিত। এই সার্বক্ষণিক আমলগুলোকে শরীয়তের পরিভাষায় 'দায়েমী' (স্থায়ী বা নিরবচ্ছিন্ন) আমল বলা হয়। আজকের আর্টিকেলে আমরা পুরুষ ও মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট দায়েমী ফরজ এবং দায়েমী সুন্নত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

দায়েমী ফরজ কী?

'দায়েমী' অর্থ হলো সব সময় বা স্থায়ী। আর 'ফরজ' হলো অত্যাবশ্যকীয়। অর্থাৎ, যে কাজগুলো বা হুকুমগুলো একজন বালেগ মুসলিম নর-নারীর ওপর সর্বাবস্থায় (২৪ ঘণ্টা) পালন করা ফরজ, তাকে দায়েমী ফরজ বলে। এগুলো কোনো নির্দিষ্ট ওয়াক্তের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সাথে জড়িত।

পুরুষের দায়েমী ফরজ কয়টি ও কী কী?

পুরুষদের জন্য সাধারণত ৩টি বিষয়কে দায়েমী ফরজ হিসেবে গণ্য করা হয়। এগুলো হলো:

  1. ঈমানী হালতে থাকা: সর্বাবস্থায় দিলের মধ্যে একীন রাখা যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল। কুফর ও শিরক থেকে সবসময় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।
  2. সতর ঢেকে রাখা: নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত শরীরের অংশটুকু সবসময় ঢেকে রাখা। প্রয়োজন ছাড়া (যেমন- গোসল বা চিকিৎসা) সতর খোলা হারাম।
  3. মাহরাম নারীদের পর্দায় রাখা: নিজের অধীনস্থ মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যাদের বেপর্দা চলাফেরা থেকে বিরত রাখা এবং শরয়ী পর্দা মেনে চলতে বাধ্য করা।

মহিলাদের দায়েমী ফরজ কয়টি ও কী কী?

নারীদের জন্য দায়েমী ফরজের সংখ্যা ৫টি। তাদের দায়িত্ব ও আমল পুরুষের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ও বেশি সতর্কতার দাবি রাখে।

  1. ঈমানী হালতে থাকা: পুরুষের মতোই নারীদেরও সর্বক্ষণ ঈমান ও আকিদা ঠিক রাখা ফরজ।
  2. সতর আবৃত রাখা: মাহরাম পুরুষের সামনে মুখমণ্ডল, হাতের কবজি ও পায়ের পাতা ছাড়া পুরো শরীর ঢেকে রাখা এবং গায়রে মাহরামের সামনে আপাদমস্তক পর্দা করা।
  3. পর্দা রক্ষা করা: পরপুরুষের সামনে বা ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় পরিপূর্ণ পর্দা মেনে চলা।
  4. নিচু স্বরে কথা বলা: গায়রে মাহরাম বা পরপুরুষের কানে যেন আওয়াজ না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে নিচু স্বরে কথা বলা। কারণ নারীর কণ্ঠস্বরও পর্দার অন্তর্ভুক্ত।
  5. স্বামীর সম্পদের হেফাজত: স্বামীর অনুপস্থিতিতে বা উপস্থিতিতে তার সম্পদ ও আমানতের খেয়ানত না করা এবং তা হেফাজত করা।
পুরুষ ও মহিলাদের দায়েমী ফরজ ও সুন্নত
পুরুষ ও মহিলাদের দায়েমী ফরজ ও সুন্নত

দায়েমী সুন্নত কী?

যে আমলগুলো বা অভ্যাসগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা পালন করতেন এবং উম্মতকে পালন করতে উৎসাহিত করেছেন, সেগুলোকে দায়েমী সুন্নত বলে। এগুলো পালন করলে জীবনে বরকত আসে এবং রাসুলের মুহাব্বত নসীব হয়।

পুরুষের দায়েমী সুন্নত কয়টি ও কী কী?

পুরুষদের জন্য ১০টি গুরুত্বপূর্ণ দায়েমী সুন্নত রয়েছে যা দৈনন্দিন জীবনের অংশ হওয়া উচিত:

  1. টুপি পরিধান: গোসল ও ঘুমের সময় ছাড়া বাকি ২৪ ঘণ্টা মাথায় টুপি রাখা।
  2. চুল রাখা: সুন্নাত তরিকায় মাথার চুল রাখা। (তিনটি পদ্ধতি: হয় পুরো মাথা মুণ্ডানো, অথবা বাবরি রাখা, অথবা সবদিকের চুল সমান মাপে ছোট করা)।
  3. মোছ ছোট করা: মোছ এমনভাবে ছাঁটা যাতে ঠোঁটের লাল অংশ প্রকাশ পায়।
  4. মেসওয়াক করা: ওজুতে এবং অন্য সময়ে নিয়মিত মেসওয়াক করা।
  5. দাড়ি রাখা: এক মুষ্টি পরিমাণ লম্বা দাড়ি রাখা।
  6. সুন্নতি পোশাক: শরীয়ত সম্মত ও মার্জিত পোশাক পরিধান করা (যেমন- টাখনুর উপর কাপড় পরা)।
  7. নখ কাটা: প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হাত-পায়ের নখ কাটা (জুমার দিন কাটা উত্তম)।
  8. অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার: নাভির নিচের এবং বগলের লোম নিয়মিত পরিষ্কার করা (৪০ দিনের বেশি রাখা মাকরুহ তাহরিমি)।
  9. ঢিলা কুলুপ: পায়খানার পর পবিত্রতার জন্য ঢিলা বা টিস্যু ব্যবহার করা।
  10. ইসতিঞ্জা: প্রস্রাবের পর পবিত্রতার জন্য টিস্যু বা পানি ব্যবহার করে নিজেকে পাক রাখা।

মহিলাদের দায়েমী সুন্নত কয়টি ও কী কী?

মহিলাদের জন্য ৭টি বিশেষ দায়েমী সুন্নত রয়েছে:

  1. চুল পরিপাটি রাখা: মাথার চুল সবসময় আঁচড়িয়ে গোছালো ও পরিপাটি রাখা।
  2. মেসওয়াক করা: দাঁতের যত্ন ও সুন্নাত পালনে মেসওয়াক ব্যবহার করা।
  3. সুন্নতি পোশাক: শালীন ও শরয়ী পোশাক পরিধান করা।
  4. নখ কাটা: প্রতি সপ্তাহে হাত-পায়ের নখ কাটা।
  5. পরিচ্ছন্নতা: নিয়মিত অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা (৪০ দিনের মধ্যে অন্তত একবার)।
  6. পবিত্রতা: পায়খানা-প্রস্রাবের পর ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করা।
  7. মাসিককালীন যত্ন: হায়েজ বা মাসিকের সময় পরিচ্ছন্নতার জন্য পট্টি বা প্যাড ব্যবহার করা।

শেষ কথা:

দায়েমী ফরজ ও সুন্নতগুলো আমাদের জীবনকে সুশৃঙ্খল ও পবিত্র রাখে। এগুলো কোনো কঠিন কাজ নয়, বরং অভ্যাসে পরিণত করলে তা ইবাদতের সওয়াব এনে দেয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই আমলগুলো আঁকড়ে ধরার তৌফিক দান করুন।

Previous Post