খানার আদব ও সুন্নাত: হাদিসের আলোকে খাবার খাওয়ার নিয়ম ও দোয়া
একজন মুমিনের জীবনের প্রতিটি কাজই ইবাদত, যদি তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথে হয়। খাবার খাওয়া মানুষের একটি সহজাত ও দৈনন্দিন কাজ। কিন্তু সামান্য কিছু খানার আদব ও সুন্নত মেনে চললে এই সাধারণ কাজটিই বিশাল সওয়াবে পরিণত হয়। আজকের আর্টিকেলে আমরা হাদিসের আলোকে খাবার খাওয়ার নিয়ম, দোয়া এবং যাবতীয় খুঁটিনাটি জানবো।
খানা খাওয়ার ফরজ কয়টি?
খাবার খাওয়ার সময় কিছু মৌলিক বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরি, যেগুলোকে ওলামায়ে কেরাম খাওয়ার ফরজ বা আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মূলত দুটি বিষয় এখানে মুখ্য:
- হালাল রিযিক: খাবারটি অবশ্যই হালাল উপার্জনের এবং পবিত্র হতে হবে। হারাম খাদ্য ইবাদত কবুলের পথে বাধা। আল্লাহ বলেন, "হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে আমরা যেসব পবিত্র বস্তু দিয়েছি তা থেকে খাও।" (সূরা বাকারা: ১৭২)
- খালেস নিয়ত: খাওয়ার উদ্দেশ্য হতে হবে কেবল উদরপূর্তি বা স্বাদ গ্রহণ নয়, বরং এই খাবার খেয়ে শরীরে যে শক্তি হবে সেটা দিয়ে আল্লাহর ইবাদত অরবো এই নিয়ত করা।
খানা খাওয়ার সুন্নত কয়টি ও কি কি?
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে খানার অসংখ্য সুন্নত ও আদব পাওয়া যায়। এগুলোকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি: খাওয়ার পূর্বের, খাওয়ার সময়ের এবং খাওয়ার পরের সুন্নত।
ক) খাওয়ার পূর্বের আদব ও সুন্নতসমূহ:
- দস্তরখানা বিছানো: মাটিতে বা ফ্লোরে দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়া। এটি বিনয়ের প্রতীক। (বুখারী)
- উভয় হাত ধোয়া: খাওয়ার আগে কবজি পর্যন্ত দুই হাত ধোয়া। হাত মোছা যাবে না, ভিজা রাখা ভালো। (তিরমিযী)
- জুতা খোলা: জুতা বা সেন্ডেল খুলে আরাম করে বসা। (মিশকাত)
- বসার ধরণ: বিনয়ের সাথে বসা। যেমনঃ নামাজের মতো হাঁটু গেড়ে বসা অথবা ডান পা খাড়া রেখে বাম পায়ের ওপর বসা অথবা দুই হাটু উঠিয়ে বসা। হেলান দিয়ে বসা নিষেধ।
- বিসমিল্লাহ বলা: খাওয়ার শুরুতে উচ্চস্বরে 'বিসমিল্লাহ' বলা, যাতে অন্যরাও স্মরণ করতে পারে।
খ) খাওয়ার সময়ের আদব ও সুন্নতসমূহ:
- ডান হাত ব্যবহার: অবশ্যই ডান হাতে খাবার খাওয়া। বাম হাতে খাওয়া শয়তানের কাজ। (মুসলিম)
- সামনে থেকে খাওয়া: এক জাতীয় খাবার হলে নিজের সামনের দিক থেকে খাওয়া। পাত্রের মাঝখান থেকে না খাওয়া, কারণ মাঝখানে বরকত নাযিল হয়। (তিরমিযী)
- তিন আঙ্গুল দিয়ে খাওয়া: বৃদ্ধাঙ্গুলি, তর্জনী ও মধ্যমা—এই তিন আঙ্গুল দিয়ে খাওয়া সুন্নত। (মুসলিম)
- খাবারের দোষ না ধরা: খাবার পছন্দ হলে খাওয়া, না হলে চুপ থাকা। খাবারের নিন্দা করা বা দোষ ধরা সুন্নতের খেলাফ। (বুখারী)
- পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া: লোকমা পড়ে গেলে তা তুলে পরিষ্কার করে খেয়ে নেওয়া। এটি অহংকার দূর করে।
- অতিরিক্ত গরম না খাওয়া: খাবার কিছুটা ঠান্ডা করে খাওয়া। ফুঁ দেওয়া নিষেধ।
গ) খাওয়ার পরের আদব ও সুন্নতসমূহ:
- পাত্র ও আঙ্গুল চেটে খাওয়া: খাওয়ার শেষে প্লেট এবং আঙ্গুল চেটে খাওয়া। কারণ খাবারের কোন অংশে বরকত আছে তা আমরা জানি না। (মুসলিম)
- শোকরিয়া আদায় (দোয়া): খাওয়ার পর আল্লাহর প্রশংসা বা 'আলহামদুলিল্লাহ' বলা এবং মাসনুন দোয়া পড়া।
- হাত ও মুখ ধোয়া: খাওয়ার পর হাত ধোয়া এবং কুলি করে মুখ পরিষ্কার করা। (বুখারী)
- দস্তরখানা উঠানো: দস্তরখানা উঠানোর পর নিজে ওঠা।
খানা খাওয়ার দোয়া সমূহ
খাবারের শুরুতে:
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি ওয়া 'আলা বারাকাতিল্লাহ।
অর্থ: আল্লাহর নামে এবং আল্লাহর বরকতের ওপর (খেতে শুরু করছি)।
বিসমিল্লাহ ভুলে গেলে (মাঝপথে মনে পড়লে):
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি আউয়ালাহু ওয়া আখিরাহ।
অর্থ: আমি এর শুরুতে এবং শেষে আল্লাহর নাম নিচ্ছি।
খাবারের শেষে দোয়া:
উচ্চারণ: আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আত‘আমানা ওয়া সাকানা ওয়া জা‘আলানা মিনাল মুসলিমিন।
অর্থ: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের আহার করিয়েছেন, পান করিয়েছেন এবং মুসলিম হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।
জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
নিচে খানা ও পানীয় সম্পর্কে বহুল জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্নের উত্তর হাদিসের আলোকে দেওয়া হলো।
নবীজি (সা.)-এর সুন্নাহ ও অভ্যাস
প্রশ্ন: নবীজি (সা.) কীভাবে বসে খাবার খেতেন?
উত্তর: নবীজি (সা.) কখনও হেলান দিয়ে খাবার খেতেন না। তিনি বিনয়ের সাথে, সাধারণত হাঁটু গেড়ে অথবা ডান পা খাড়া করে বাম পায়ের ওপর বসে খাবার খেতেন। তিনি বলতেন, "আমি তো একজন সাধারণ বান্দা, তাই বান্দার মতোই খাই এবং বসি।"
প্রশ্ন: নবীজি (সা.)-এর প্রিয় খাবার কোনটি ছিল?
উত্তর: নবীজি (সা.)-এর প্রিয় খাবারের মধ্যে ছিল সারিদ (রুটি ও গোশতের ঝোল মিশ্রিত খাবার), লাউ, মধু, দুধ এবং খেজুর। তিনি মিষ্টান্ন পছন্দ করতেন।
প্রশ্ন: সারিদ কী?
উত্তর: সারিদ হলো আরবদের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা গোশতের ঝোলের মধ্যে রুটির টুকরো ভিজিয়ে তৈরি করা হয়। এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর।
খাওয়ার নিয়ম-কানুন
প্রশ্ন: দস্তরখানা বিছানো কি সুন্নত?
উত্তর: হ্যাঁ, দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এটি খাবারের প্রতি সম্মান এবং বিনয় প্রকাশ করে।
প্রশ্ন: ডাইনিং টেবিলে খাওয়া কি জায়েজ?
উত্তর: ডাইনিং টেবিলে খাওয়া জায়েজ (বৈধ), এতে গুনাহ হবে না। তবে মাটিতে দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়া অধিক বিনয়পূর্ণ এবং সুন্নতের নিকটবর্তী।
প্রশ্ন: বিছানায় বসে বা শুয়ে খাওয়া কি জায়েজ?
উত্তর: শুয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি সুন্নতের খেলাফ। অসুস্থতা বা ওজর ছাড়া বিছানায় বসে খাওয়া অনুচিত, এতে বিছানা অপরিচ্ছন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ওজর থাকলে জায়েজ আছে।
প্রশ্ন: শব্দ করে খাওয়া সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
উত্তর: ইসলামে শালীনতার গুরুত্ব অনেক। চপচপ শব্দ করে খাওয়া ভদ্রতার খেলাফ এবং এতে পাশের মানুষের বিরক্তি হতে পারে, তাই নিঃশব্দে ও ভদ্রভাবে খাওয়া উচিত।
প্রশ্ন: খাওয়ার সময় কথা বলা কি জায়েজ?
উত্তর: খাওয়ার সময় একদম চুপ থাকা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের রীতি। ইসলামে খাওয়ার সময় ভালো কথা বা দ্বীনি আলোচনা করা মুস্তাহাব। তবে খাওয়ার সময় অপ্রয়োজনীয় বা বাজে কথা বলা উচিত নয়।
প্রশ্ন: খাওয়ার সময় সালাম দেওয়া যাবে কি?
উত্তর: কেউ মুখে খাবার থাকা অবস্থায় তাকে সালাম দেওয়া উচিত নয়। তবে খাবারের ফাঁকে বা মুখে খাবার না থাকলে সালাম দেওয়া ও উত্তর দেওয়া যাবে।
বিবিধ মাসায়েল
প্রশ্ন: ফুঁ দিয়ে খাবার বা চা খাওয়া সম্পর্কে হাদিস কী?
উত্তর: হাদিসে খাবারে বা পানীয়তে ফুঁ দিতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে (ইবনে মাজাহ)। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতেও এটি ক্ষতিকর, কারণ শ্বাসের সাথে কার্বন ডাই-অক্সাইড খাবারে মিশে যায়।
প্রশ্ন: মানুষকে খাওয়ানোর ফজিলত কী?
উত্তর: মানুষকে খাওয়ানো জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। রাসুল (সা.) বলেছেন, "তোমরা সালাম প্রচার করো এবং মানুষকে খাবার খাওয়াও... তবেই নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।"
প্রশ্ন: রাতে না খেলে কী হয়?
উত্তর: হাদিসে বলা হয়েছে, রাতের খাবার একেবারে বাদ দিও না, প্রয়োজনে সামান্য খেজুর হলেও খাও। কারণ রাতের খাবার বর্জন করলে শরীর দ্রুত বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হয় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।
খাওয়ার আদব ও দোয়া PDF ডাউনলোড
আপনি কি এই আর্টিকেলটি সংরক্ষণ করে রাখতে চান? অথবা প্রিন্ট করে নিজের কাছে রাখতে চান? তাহলে নিচের লিংকে(শীঘ্রই লিংক যুক্ত হচ্ছে) ক্লিক করে "খানার আদব ও সুন্নাত" এর পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করে নিন।