মাস্তুরাতের বয়ান | হযরতজী মাওলানা এনামুল হাসান (রাহঃ)

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,

আল্লাহ তাআ’লা এই পৃথিবীকে দুইভাবে আবাদ করেছেন। একটি হলো বাহ্যিক আবাদ, যা পুরুষ ও নারীদের মাধ্যমে হয়। অন্যটি হলো হাকিকী বা আধ্যাত্মিক আবাদ, যা দ্বীনের কাজে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যেমন নারী-পুরুষের মিলনের ফলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে, মানবজাতি বৃদ্ধি পায় এবং দুনিয়া আবাদ হয়; ঠিক তেমনি নারী-পুরুষের সম্মিলিত দ্বীনি প্রচেষ্টার মাধ্যমে দ্বীনের আবাদ হয়, যা হলো প্রকৃত আবাদ। এজন্য পুরুষের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি নারীদেরও সমান দায়িত্ব রয়েছে।

আমাদের ঘরগুলো যদি আমরা সাধারণ ও সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে পরিচালনা করি, বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার পরিবর্তে দ্বীনি আমল দ্বারা সেগুলোকে আবাদ রাখি, তাহলে আমাদের ঘরে নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর জিকির প্রভৃতি আমল চালু হবে। আমাদের সময়গুলো যদি এই আমলের সাথে যুক্ত থাকে, তবে আমাদের সন্তানেরাও এমন পরিবেশে জন্মগ্রহণ করবে এবং লালিত-পালিত হবে। ঘরের পরিবেশ যেমন হবে, সন্তানদের উপর তার প্রভাবও তেমনই পড়বে। এজন্য বলা হয়, সন্তানের প্রথম মাদ্রাসা হলো মায়ের কোল এবং ঘরের পরিবেশ। যদি আমাদের ঘর দ্বীনি পরিবেশে পরিপূর্ণ হয়, আমাদের থাকা-খাওয়া, চলাফেরা দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, তবে আমাদের পুরুষদের মধ্যে যেমন দ্বীনের উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে, তেমনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যেও দ্বীনের প্রতি আগ্রহ ও যজবা জাগ্রত হবে।

মাস্তুরাতের বয়ান | হযরতজী মাওলানা এনামুল হাসান (রাহঃ)
মাস্তুরাতের বয়ান | হযরতজী মাওলানা এনামুল হাসান (রাহঃ)

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত যেন আমাদের ঘরগুলো দ্বীনি পরিবেশে পরিণত হয়। আমাদের সমাজ যেন ইসলামী সমাজে রূপান্তরিত হয়। আমরা যেন দুনিয়ার দিক থেকে সরল জীবন অবলম্বন করি এবং আখিরাতের চিন্তায় নিমগ্ন থাকি। আল্লাহ তাআ’লা নারীদেরকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যেন তারা স্বামীর জন্য শান্তি ও স্বস্তির কারণ হয়। কুরআনে আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন (মোটামুটি অর্থ), “নারীরা তাদের স্বামীদের জন্য শান্তির কারণ।” স্বামী যতই ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরুক না কেন, যদি তার স্ত্রী ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সাথে তার সাথে মেলামেশা করে, তবে তার সমস্ত ক্লান্তি ও দুঃখ দূর হয়ে যায়।

যখন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর প্রথম ওহি নাজিল হয়, তখন তিনি ঘরে ফিরে আসেন। সে সময় তাঁর শরীরে অস্থিরতা ও কম্পন ছিল। হযরত খাদিজা (রাঃ) তাঁকে শান্ত করে বললেন, “আপনি ভয় পাবেন না, আল্লাহ তাআ’লা আপনাকে কখনো লজ্জিত করবেন না, আপনাকে অসহায় ছাড়বেন না।” বারবার এমন ঘটনা ঘটেছে, আর প্রতিবারই হযরত খাদিজা (রাঃ) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। পরে তিনি নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে নিয়ে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নাওফেলের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন।

এখানে আমি এই বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই যে, কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী নারী তার স্বামীর জন্য শান্তির উৎস। কিন্তু যদি স্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তা শুধু দুনিয়াবী জিনিসের প্রতি সীমাবদ্ধ থাকে, তবে স্বামীও দুনিয়াবী জিনিসের পেছনে ছুটতে গিয়ে বিপর্যস্ত হবে। কিন্তু যদি স্ত্রী তার জীবনযাত্রা সরল রাখে, দ্বীনি আমলের প্রতি মনোযোগী হয় এবং স্বামীকে দ্বীনের কাজে উৎসাহিত করে, তবে সে শুধু ঘরের আবাদের কারণই হবে না, বরং দ্বীনের আবাদেরও কারণ হবে। এজন্য আমাদের সরল জীবনযাপন গ্রহণ করতে হবে। স্বামীর কাছে দুনিয়াবী জিনিস বা সম্পদের দাবি না করে দ্বীনের বিষয়ে আগ্রহী হতে হবে। স্বামীকে দুনিয়ার পেছনে ছুটতে না দিয়ে আমল শেখার, আমল করার এবং আখিরাতের চিন্তা জাগ্রত করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। এই কাজগুলোর মাধ্যমে নিজেদেরও দ্বীনের সাথে যুক্ত রাখতে হবে। তাহলে আমাদের জীবন শান্তিতে কাটবে, স্বামীর জীবনও শান্তিতে কাটবে। এমনকি শুকনো রুটি খেলেও আমরা শান্তি ও স্বস্তি লাভ করব।

কিন্তু যদি আমাদের আকাঙ্ক্ষা, কথাবার্তা, চলাফেরা শুধু দুনিয়ার জিনিসের জন্য হয়, তবে আমরাও অশান্ত থাকব, পুরুষেরাও অশান্ত থাকবে। কারণ দুনিয়ার আকাঙ্ক্ষা কখনো পূর্ণ হয় না। একটি জিনিস হাসিল হলে আরেকটি জিনিসের প্রতি লোভ জাগে। এভাবে মৃত্যু এসে যায়, তবুও আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না।

একবার নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাটিতে একটি লম্বা রেখা টানলেন। তার দুই পাশে ডানে-বামে অনেকগুলো ছোট ছোট রেখা আঁকলেন। তারপর একটি সরল রেখা টানলেন, যা সব রেখা অতিক্রম করে বাইরে চলে গেল। তিনি বললেন, “এই ডান-বামের ছোট রেখাগুলো হলো মানুষের আকাঙ্ক্ষা। এগুলো মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে, কিন্তু কখনো পূর্ণ হয় না।” যদি মানুষ তার আকাঙ্ক্ষার পেছনে ছুটতে থাকে, তবে এই আকাঙ্ক্ষা তাকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘিরে রাখে, ছাড়ে না।

হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রাহঃ) বলেছেন, “মানুষের আকাঙ্ক্ষা কখনো পূর্ণ হয় না। মানুষের মন সবসময় কিছু না কিছু চায়। এমনকি যখন একটি জিনিস হাসিল হয়, তখনও সে আখিরাতের জন্য আরও চায়।”

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমাদের চিন্তা করতে হবে যে, যদি আমরা আকাঙ্ক্ষার পেছনে ছুটি, তবে মৃত্যু পর্যন্ত শান্তি পাব না, এমনকি মৃত্যুর পরেও শান্তি পাব না। কিন্তু যদি আমরা আল্লাহর আহকাম মেনে চলি এবং স্বামীদেরকেও তা মানতে উৎসাহিত করি, তবে আমাদের দুনিয়ার জীবন শান্তিতে কাটবে এবং আখিরাতেও আল্লাহ তাআ’লা আমাদের পুরস্কৃত করবেন।

দিলের অবস্থা পরিবর্তন করা কঠিন কিছু নয়। যদি দিল আখিরাতমুখী হয়, তবে সবকিছু সহজ হয়ে যায়। মানুষ যখন দুনিয়ার ফাঁদে পড়ে, দুনিয়ার জিনিসের পেছনে ছুটতে থাকে, তখন তার আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। ফলে সে দুনিয়ার মধ্যে আটকে যায় এবং ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু যদি আখিরাতের চিন্তা জাগ্রত হয়, তবে আল্লাহ তাআ’লা তার দুনিয়ার প্রয়োজনগুলো পূরণ করে দেন এবং আখিরাতের কামিয়াবিও অর্জিত হয়। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি তার আকাঙ্ক্ষাকে আখিরাতের জন্য নির্ধারণ করে, আল্লাহ তার দুনিয়ার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পূরণ করে দেন। কিন্তু যে ব্যক্তি তার দিলকে দুনিয়ার পেছনে লাগায়, তার মন দুনিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং সে ধ্বংসের পথে চলে যায়।”

হযরত আবু দারদা (রাঃ) তাঁর দোয়ায় বলতেন, “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে দিলের তাফরিকাত (বিভক্তি) থেকে পানাহ চাই।” তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, দিলের তাফরিকাত হলো এমন অবস্থা, যখন মানুষের সম্পদ ও আকাঙ্ক্ষা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকে, ফলে তার দিল সবসময় অশান্ত থাকে। এজন্য আমাদের দিলকে দুনিয়ার জিনিস থেকে মুক্ত রাখতে হবে। আমাদের দিল শুধু আখিরাতের সাথে সংযুক্ত রাখতে হবে। যখন দিল আখিরাতের চিন্তায় নিমগ্ন থাকবে, তখন দুনিয়ার জিনিস আমাদের কাছে আরামের নয়, বরং পেরেশানির কারণ মনে হবে।

প্রিয় বোনেরা, আমাদের ভাবতে হবে, এই দুনিয়ার জীবন কত দিনের? খুবই সাময়িক। কার কত দিন বাকি, তা কেউ জানে না। এই স্বল্প সময়ের জীবনে যদি দিলকে দুনিয়ার ফাঁদে ফেলে দিই, তবে দুনিয়াতেও অশান্তি আর আখিরাতেও বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। সবচেয়ে সহজ পথ হলো, আমাদের দিলকে শুধু আখিরাতের সাথে সংযুক্ত রাখা। যখন দিল আখিরাতমুখী হবে, তখন দ্বীনি আমলগুলো আমাদের কাছে আনন্দদায়ক ও শান্তিপ্রদ মনে হবে।

আখিরাতকে লক্ষ্য করে যে ব্যক্তি কাজ করে, সে দ্বীনি কাজে আনন্দ ও শান্তি পায়। কিন্তু যে দুনিয়াকে লক্ষ্য করে কাজ করে, সে দুনিয়ার জিনিসের পেছনে ছুটতে থাকে, কিন্তু শান্তি পায় না। কারণ দুনিয়ার কোনো জিনিসে প্রকৃত শান্তি নেই। শান্তি আছে আল্লাহর দেওয়া আমলের মধ্যে এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহর মধ্যে।

আমাদের চিন্তা ও প্রচেষ্টা যেন আখিরাতকেন্দ্রিক হয়। আমাদের জীবন যেন আখিরাতের প্রস্তুতির জন্য নিয়োজিত থাকে। তাহলে আমাদের জীবন শান্তিতে কাটবে এবং আখিরাতের শান্তিও অর্জিত হবে। আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন, দুনিয়ার সুখ-শান্তি, সম্পদ, সন্তান, খেলা-তামাশা এগুলো সবই ধোকা। এগুলোর পেছনে জীবন ব্যয় করলে দুনিয়াতেও অশান্তি এবং আখিরাতেও বিপদ।

হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রাহঃ) এর স্ত্রী ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন বাদশাহ আব্দুল মালিকের কন্যা। তাঁর পিতা, ভাই এবং স্বামী—সবাই ছিলেন বাদশাহ। ইতিহাসে এমন উচ্চ পর্যায়ের নারী বিরল। তবুও হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রাহঃ) যখন খলিফা হলেন, তিনি দুনিয়ার সব আরাম ত্যাগ করে আখিরাতের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। ফাতিমা (রাঃ) তাঁর পিতার একমাত্র কন্যা ছিলেন, ভাইদের কাছে আদরের এবং পিতার কাছে স্নেহের পাত্রী ছিলেন। কিন্তু তিনি স্বামীর সাথে সরল জীবন গ্রহণ করলেন। তাঁদের ঘরে কোনো খাদিম-গোলাম ছিল না। ফাতিমা (রাঃ) নিজ হাতে রুটি তৈরি করতেন।

একদিন এক বৃদ্ধা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “সম্রাজ্ঞী কোথায়?” তাকে বলা হলো, “যার সাথে তুমি কথা বলছ, তিনিই সম্রাজ্ঞী।” বৃদ্ধা দেখলেন, ঘরের এক কোণে একজন শ্রমিক কাদামাটির কাজ করছেন। তিনি ফাতিমাকে বললেন, “এই পরপুরুষের দৃষ্টি তোমার উপর পড়ছে।” ফাতিমা (রাঃ) বললেন, “ইনি পরপুরুষ নন, ইনি আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রাহঃ)।” এই ছিল তাঁদের জীবনের অবস্থা, যাঁদের দিল আখিরাতের দিকে মুখী ছিল।

বৃদ্ধা ফাতিমাকে বললেন, “তোমরা তোমাদের ঘরের এমন অবস্থা করেছ?” ফাতিমা (রাঃ) উত্তর দিলেন, “আমরা আমাদের ঘরকে কুরবানি করেছি, কিন্তু জনগণের ঘরগুলোকে আবাদ করেছি।”

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, যখন আমাদের ফিকির আখিরাতের দিকে থাকবে, তখন দুনিয়ার জিনিস আমাদের কাছে আরামের নয়, বরং পেরেশানির কারণ মনে হবে। হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রাহঃ) তাঁর স্ত্রী ফাতিমাকে বলেছিলেন, “তুমি যদি আমার সাথে থাকতে চাও, তবে হার ত্যাগ করতে হবে। নইলে হার নিয়ে চলে যাও।” ফাতিমা বললেন, “আমি আমীরুল মুমিনীনের সাথে থাকতে চাই, হার ত্যাগ করব।”

হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) মৃত্যুর সময় কাঁদতে শুরু করলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন কাঁদছেন?” তিনি বললেন, “দেখছ না, দুনিয়ার জিনিসগুলো সাপের মতো আমাকে ঘিরে আছে?” তাঁর কাছে মাত্র একটি লোটা ও কিছু সামান্য জিনিস ছিল, তবুও তিনি সেগুলোকে সাপের সাথে তুলনা করলেন। কারণ তাঁর দৃষ্টি আখিরাতের দিকে ছিল।

আমাদের শত্রু হলো শয়তান। সে দুনিয়ার রঙ-ঢঙ দেখিয়ে আমাদের দিলকে আখিরাত থেকে ফিরিয়ে দেয়। তাই আমাদের শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচতে হবে, আখিরাতের ফিকির করতে হবে এবং দ্বীনি আমলকে সুন্দর করতে হবে।

বিঃ দ্রঃ হযরতজী মাওলানা এনামুল হাসান (রাহঃ) ২১-০১-১৯৯৪, শুক্রবার টঙ্গীর ময়দানে এই বয়ানটি করেছিলেন।

Previous Post